
ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন রেলপথে চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিনগুলো ঘন ঘন বিকল হয়ে যাচ্ছে। মেয়াদোতীর্ণ পুরনো ও অচলপ্রায় ইঞ্জিনে ট্রেন চলাচল করায় মাঝপথে বিকল হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেমে থাকা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এতে তীব্র গরমে শিশু মহিলা ও বৃদ্ধসহ অনেক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ট্রেনের সকল যাত্রীরা সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ট্রেনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। যাদের জরুরি যাতায়াত করা প্রয়োজন তারা রেল ভ্রমণ পরিহার করে বিকল্প যানবাহনে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছে।
গতকাল রবিবার (০৫ অক্টোবর) জামালপুর- ময়মনসিংহ রেলপথের নান্দিনা রেল স্টেশনে জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা ব্রহ্মপূত্র এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনের ইঞ্জিনটি সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে বিকল হয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ময়মনসিংহের কেওয়াটখালি লোকোশেড থেকে একটি বিকল্প ইঞ্জিন গেলে ওই ইঞ্জিনটি বিকল ইঞ্জিনসহ টেনে ঢাকা কমলাপুর রেলষ্টেশনে নিয়ে যায়। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে ব্রহ্মপূত্র এক্সপ্রেস ট্রেনটি ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন ষ্টেশন হতে ৪ ঘন্টা যাত্রীদের বসে থেকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
পটুয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিএম এর ৪র্থ সেমিষ্টারে শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম (মুন) সহ একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জানান, ঢাকার কমলাপুর হয়ে বরিশাল যাবার পথে আন্তঃনগর ব্রহ্মপূত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেটে সকাল সোয়া ৮টায় ময়মনসিংহ রেলষ্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি। সাথে ৪টি ব্যাগ নিয়ে কোথাও খেতেও যেতে পারছি না। অভূক্ত অবস্থায় দুপুর একটার দিকে অবশেষে ট্রেনটি ঢাকা উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ ছেড়ে যায়। তার মতো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় এক শত শিক্ষার্থী ওই ট্রেনে রয়েছে। এছাড়াও অনেক শিশু-বৃদ্ধ ও মহিলারাও ভীষণ কষ্ট করে ট্রেনে যাতায়াত করছে।
গফরগাঁও আলতাফ গোলন্দাজ ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আতিকুর রহমান বলেন, সকাল ১১টায় কলেজে জরুরি মিটিং তাই সকাল ৮টা ২০ মিনিটে স্ট্যান্ডিং টিকিট কেটে ময়মনসিংহ রেলষ্টেশনে ব্রহ্মপূত্র ট্রেনের জন্য সকাল ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করে কাউন্টারে গিয়ে টিকিটের টাকা ফেরত চাইলে তিনি পাননি। অবশেষে টাকা গচ্ছা দিয়েই সিএনজি যোগে বিকল্প পথে গফরগাও যান তিনি।
রেলওয়ে সূত্র জানা গেছে, ময়মনসিংহ রেলওয়ে বিভাগের অধীনে চলাচলরত বেশিরভাগ ট্রেনই পুরনো ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরশীল। এসব ইঞ্জিনের অনেকগুলোই নির্ধারিত আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। তবুও পর্যাপ্ত নতুন ইঞ্জিন সংযোজন না হওয়ায় বাধ্য হয়ে সেগুলোকেই ব্যবহার করছে কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের মতে, পর্যাপ্ত বাজেট ও জনবল ঘাটতির কারণে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয় না। ফলে একদিকে বাড়ছে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঝুঁকি, অন্যদিকে কমছে ট্রেনের গতি ও নিরাপত্তা।
স্থানীয় যাত্রী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “প্রায়ই ট্রেন মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। কেউ ঠিকভাবে জানায় না কখন আবার চলবে। আমাদের কাজের সময় নষ্ট হয়, অনেক সময় বিকল্প পথে যেতে হয়।”
আরিফুর রহমান নামের আরেক যাত্রী জানান, “রেলের প্রতি আস্থা ছিল, কিন্তু এখন প্রায়ই ট্রেন বিকল হয়, সময়মতো কোথাও পৌঁছানো যায় না। তাই অনেকে বাসে যাতায়াত শুরু করেছেন।”
রেলওয়ের ময়মনসিংহ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা জানি পুরনো ইঞ্জিনের কারণে সমস্যা হচ্ছে। নতুন ইঞ্জিন সংযোজনের প্রক্রিয়া চলছে। মেরামতের কাজও বাড়ানো হয়েছে, তবে সময় লাগবে।”
রেল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রেন সেবার প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দ্রুত নতুন ইঞ্জিন সরবরাহ, পুরনো ইঞ্জিন সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি। তাদের মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থায় রেলের ভূমিকা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বারবার বিকল হয়ে পড়া ও অনিয়মিত সেবা যাত্রীদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে।
পুরনো ইঞ্জিনের কারণে ট্রেন বিকল হওয়া এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং নিয়মিত চিত্রে পরিণত হয়েছে। এতে যাত্রীরা যেমন ভোগান্তিতে পড়ছেন, তেমনি দেশের অন্যতম সাশ্রয়ী গণপরিবহন রেলের প্রতি মানুষের আস্থাও ক্রমে কমে যাচ্ছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এ আস্থা পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ময়মনসিংহ লোকোসেডের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলে চলাচলকারী ট্রেনে ব্যবহার হওয়া ২ হাজার থেকে ৩ হাজার সিরিজের ইঞ্জিন গুলো বহু আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২০০ সিরিজ, ২ হাজার ৫০০ সিরিজ ও ২ হাজার ৮০০ সিরিজের ইঞ্জিন রেলপথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকী ইঞ্জিন গুলো দিয়ে চলছে ট্রেন গুলো। বিকল হওয়া ট্রেনের ইঞ্জিন গুলোর মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইঞ্জিন গুলোতে ইঞ্জিনের চাকা ঘুরানোর জন্য যে ট্রাকশন মোটর রয়েছে সেটির ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। এছাড়া বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণেও বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ দুই ধরণের জটিলতা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (কারখানা) মোস্তাফিজুর রহমান ভূঞা বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলে প্রতিদিন যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ১১৯টির মতো ইঞ্জিন দরকার। কিন্তু এখন আমরা প্রতিদিন গড়ে ৭৫ থেকে ৭৬টি ইঞ্জিন পাই। এখন মালবাহী ট্রেন থেকে ইঞ্জিন এনে কোনোরকমে সামাল দেয়া হচ্ছে। একটা লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) কারখানায় আসার পর ভালোভাবে মেরামত করে দেওয়ার মতো সময়ও পাচ্ছি না। কারণ যাত্রী নিয়ে যে ট্রেনে লোকোমোটিভটা আসছে সেটা অন্য ট্রেনে দিতে হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, পূর্বাঞ্চলে যাত্রীবাহী ট্রেনে যতগুলো ইঞ্জিন চলছে তার ৫০ শতাংশের বেশি আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ ২০ বছরের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। যে কারণে ইঞ্জিনে যান্ত্রিক ত্রুটি বেশি দেখা দিচ্ছে।